রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: দেশজুড়ে সাপ নিধনে যে সংকট তৈরি হবে

গত কয়েক মাস ধরেই রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাসেলস ভাইপার সাপ মনে করে আতঙ্কে সব ধরনের সাপ পিটিয়ে মারা হচ্ছে। আর সাপ নিধনের এই অবস্থা থেকে সরে না আসলে বেশ কিছু সংকটের মুখোমুখী হতে যাচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষ।

মঙ্গলবার (২৫ জুন) বিবিসির এ প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সাপের হঠাৎ প্রাদুর্ভাবে ছড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গুজবও।

তবে বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছে, বাংলাদেশে ৮৫ ভাগের বেশি সাপেরই বিষ নেই। এমনকি রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ বিষধর সাপের তালিকায় ৯ নম্বরে রয়েছে। আর এখন আতঙ্কিত হয়ে মানুষ যেসব সাপগুলো মারছে তার বেশিরভাগই নির্বিষ ও পরিবেশের জন্য উপকারী।

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপ জীববৈচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই অন্যান্য প্রাণীর মতই সাপও গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় সাপের ভূমিকা অপরিসীম। বস্তুত সাপ প্রকৃতির বন্ধু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য ও অত্যাবশ্যকীয় অংশ। বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষস্থানীয় মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যে সাপ অন্যতম।

‘বাংলাদেশের সাপ ও সর্পদংশন প্রতিরোধ ও চিকিৎসা’ নামক বইতে বলা হয়েছে, সাপ খুব অলস ও নিরীহ প্রাণী। সাপ মানুষকে ভয় পায়, ফলে মানুষ দেখলে সাপ পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে চায়। কিন্তু সাপের উপর আক্রমণ হলে আত্মরক্ষার জন্য সাপ মানুষকে কামড় দেয়। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় সাপ অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করে।

এই বইটি যৌথভাবে লিখেছেন মো. আবু সাইদ এবং মো. ফরিদ আহসান।

বইটির লেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ফরিদ আহসান বলেন, ‘এই চক্রে সাপ শিকারি এবং শিকার উভয়ই হতে পারে। কারণ সাপ যেমন অন্য প্রাণী খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে তেমনি সাপও অন্য প্রাণীর খাদ্য হয়ে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে’।

এই চক্রে সাপ কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের একটি প্রাকৃতিক রূপ। কারণ শিকারি হিসেবে সাপ যেসব প্রাণী খায়, সেটার ভারসাম্য বজায় রাখে। প্রাণীবিদরা বলছেন, ১০০ বছর আগেও এই রাসেলস ভাইপার সাপের উপস্থিতি ছিল এ এলাকায়। এখন এই সাপ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন হয়েছে।

অর্থাৎ এদের যেসব প্রাণী খেতো সেসব প্রাণীর সংখ্যা এখন কমে গেছে। যেমন: গুইসাপ, বেজি, চিল, ঈগল, গন্ধগোকুল এ ধরনের বিভিন্ন প্রাণীর সংখ্যা কমে গেছে। ফলে বেড়ে গেছে সাপের সংখ্যা।

আহসাম বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপ বেড়ে যাওয়ার কারণ ইকো সিস্টেমে রদবদল হয়েছে। এদের যারা খেত সেসব প্রাণীর সংখ্যা কমে গেছে। ফলে এই সাপের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতির অংশ হিসেবে সাপ মেরে ফেললে এর প্রভাব পড়বে পুরো বাস্তুচক্রে। ফসলি ক্ষেতে সাপ মারলে ইঁদুরের প্রভাব বাড়বে। সাধারণত প্রতি বছরই ১০ থেকে ২০ শতাংশ ফসল ইঁদুর নষ্ট করে। ফলে নির্বিচারে সাপ মারলে ইঁদুরের সংখ্যা বাড়বে। উৎপাদন কমে যাবে ফসলের।

বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক হোসাইন বলেন, সাপ ব্যাঙ, ইঁদুর খায়। বেজি, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল সাপ খায়। আবার শঙ্খচূড়, গোখরা, কেউটে এই সাপগুলোও রাসেলস ভাইপারসহ অন্য সাপ খায়।

তিনি বলেন, ফসলী খেতে সাপ ইঁদুর খায়। তারা ইঁদুর খেয়ে ফসলের উপকার করে। এভাবে যদি প্রচুর পরিমাণ সাপ মারা হয় তবে এক শ্রেণির শিকারি প্রাণী কমে যাবে। এর কারণে, ভবিষ্যতে ইঁদুর বেড়ে যাবে। সেগুলো ফসল খেয়ে নষ্ট করে ফেলবে। উৎপাদন কমে যাবে ফসলের। যেটা ফুড সাইকেলে প্রভাব ফেলবে। এভাবে সাপ মারলে ভবিষ্যতের জন্য অনেক ক্ষতি হবে।

বাংলাদেশে সাপ নিয়ে নেতিবাচক ধারণার কারণে এ ধরনের প্রাণী নির্বিচারে মারা হয়। কিন্তু, বাস্তুতন্ত্রে সাপের ভূমিকা অন্য কেউ পূরণ করতে পারে না বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া।

আমিনুল ইসলাম বলেন, ইকোসিস্টেমে সাপের যে রোল রয়েছে তার তো কোন রিপ্লেসমেন্ট করা যায় না। এই সিস্টেমের প্রতিটি প্রাণীর প্রভাব অপরটিকে প্রভাবিত করে। ফলে সাপের অভাবে টোটাল ফুড চেইনে প্রভাব পড়বে।

২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী, রাসেলস ভাইপার সাপকে সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার সাপ মারা, ধরা এবং বহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

এরই মধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সাপ না মারার আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতিও প্রকাশ করেছে।