‘১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর হলে পর্যটনের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে’

মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৩ শতাংশেরও বেশি অবদান দেশের পর্যটন খাতের। তবে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে (২০২৪-২৫) সুবিধা না বাড়িয়ে, বরং আরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সরকারের এমন পরিকল্পনাকে দেশের পর্যটন শিল্প সম্প্রসারণের পথে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ট্যুর অপারেটরদের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আরোপের প্রস্তাব কার্যকর হলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ভ্রমণ ব্যাহত হবে ।

গত ৬ জুন সংসদে বাজেট প্রস্তাবনায় এ খাতের কর সুবিধা উঠিয়ে দিয়ে বরং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। প্রস্তাবিত বাজেটে ট্যুর অপারেটর সেবার ওপর বিদ্যমান ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে (মূসক বা ভ্যাট) যে অব্যাহতি রয়েছে, তা প্রত্যাহারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে বিদ্যমান ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (টোয়াব) জানায়, প্রায় ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ট্যুরিজম খাতের সঙ্গে জড়িত। সম্ভাবনাময় এই খাতে বিদ্যমান মুসক অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখতে এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলমের সঙ্গে টোয়াবের প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ করে। সেসময় মূসক প্রত্যাহারের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে টোয়াবের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করা হয়।

ভ্রমণ প্যাকেজের ওপর আবার ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে একই জিনিসের জন্য দুবার ভ্যাট দিতে হবে, যা হবে অন্যায্য এমনটা দাবি করে ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ট্যুর অপারেটর সেবায় ভ্যাট কার্যকরের সিদ্ধান্ত দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশের অনুকূল নয়; বরং এতে এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা মনে করি, এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সার্বিকভাবে ভ্রমণ ব্যয় বাড়বে; পর্যটকদের ওপর খরচের বোঝা তৈরি হবে।

মো. রাফেউজ্জামান

তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ খাতের উন্নয়নে ভ্যাটের বোঝা না বাড়িয়ে, বরাদ্দ ও প্রণোদনা বাড়ানো দরকার ছিল। এই খাত দেশের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। তাই নীতিগত পলিসি তৈরি করে, এ খাতে আরও প্রণোদনা দেয়া উচিত ছিল।

পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: চলতি বছরের বাজেটে পর্যটন খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ বাস্তবায়িত হলে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের ভ্রমণ যাত্রা ব্যাহত হবে। পর্যটকরা খাবার, যোগাযোগ ও বাসস্থান সেবার জন্য ভ্যাট দিয়ে থাকে। তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। অভ্যন্তরীণভাবে পর্যটকদের ভ্রমণ যাত্রা ব্যাহত হবে। আন্তর্জাতিক পর্যটকরাও প্বাশবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের ট্যুর প্যাকেজ যখন তুলনা করে দেখবে যে ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ডে ট্যুর প্যাকেজ কম, তখন তারা আমাদের দেশে ভ্রমণ না করলে পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে ভ্রমণ করবে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচকে-২০২২ মতে, বাংলাদেশের জিডিপিতে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের অবদান ২.২% ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান ১.৮%। বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল অবকাঠামো নিয়েও নেপালের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৯%। পর্যটন খাতে বাংলাদেশের আয় সার্কদেশগুলোর মধ্যেও কম। বর্তমানে এই খাত থেকে বার্ষিক আয় করে মার্কিন ডলারে বাংলাদেশ প্রায় ৭৬.১৯ মিলিয়ন, ভারত ১০,৭২৯ মিলিয়ন, মালদ্বীপ ৬০২ মিলিয়ন, শ্রীলঙ্কা ৩৮৫ মিলিয়ন, পাকিস্তান ২৭৬ মিলিয়ন ও নেপাল ১৯৮ মিলিয়ন।

টোয়াব সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পর্যটনে আমাদের অবস্থান সর্বনিম্ন পর্যায়ে। তবে এ খাতের সম্ভাবনা অনেক আছে। ফলে পর্যটনসংশ্লিষ্ট কোনো খাতেই ভ্যাট বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আগে খাতটিকে টেকসই হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

ড. সন্তোষ কুমার দেব

সহমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব বলেন: বর্তমানে দেশের জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। তবে একটু উদ্যোগ নিলেই এই হারকে বাড়িয়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারে অনেকখানি।

পর্যটন খাতে মূসক প্রত্যাহারে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়ে মো. রাফেউজ্জামান বলেন: ট্যুর অপারেটরেরা পর্যটনের বিভিন্ন উপখাত থেকে আলাদা উপাদান নিয়ে ভ্রমণ প্যাকেজ তৈরি করেন। যেমন আমরা আবাসনশিল্প থেকে পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা করি, ক্যাটারিং থেকে খাবার নিই ও পরিবহন খাত থেকে যানবাহন বা টিকিটের ব্যবস্থা করি। সব ক্ষেত্রেই আগে ভ্যাট পরিশোধ করা হয়।

তিনি বলেন, ট্যুর অপারেটরদের কোনো পর্যটক এর কাছ থেকে মূসক নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ট্যুর অপারেটররা যে হোটেলে পর্যটকদের রাখেন, সেই হোটেলগুলো খাবার এবং আবাসনের ওপর সরকারকে মূসক প্রদান করে থাকে। তাই আলাদা করে মূসক আরোপ করা হলে পর্যটন খাত এবং ট্যুর অপারেটর খাত মুখ থুবড় পড়বে।