তুমি একটি গন্ধরাজ চেয়েছিলে

তুমি একটি গন্ধরাজ চেয়েছিলে, আমি বলেছিলাম—এই পৃথিবীর সকল গন্ধরাজ তোমার কাছে নিয়ে আসব। শৈশবে যেভাবে শাপলা-শালুক কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। তুমি বলেছিলে, শাড়ি পরতে ভালবাসো, আমি নিয়ে এসেছিলাম সবচেয়ে নান্দনিক শাড়িটি। ভেবেছিলাম তোমায় বলব, ভালোবাসি। অথচ বলা হলো না।

তুমি বলেছিলে শাহবাগ থেকে একটি ফুল নিয়ে আসতে, আমি গোটা একটা ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিলাম। কারণ আমি শুনেছি, অমিতাভ শ্রীদেবীকে ট্রাকভর্তি ফুল পাঠিয়েছিলেন। সে তুলনায় আমি কিছুই না। কিন্তু ভালবেসেছ কী, জানি না। শুনেছি, প্রেমিকরা চিরকালই প্রত্যাখ্যাত হয়, অ-প্রেমিকরা গৃহীত হয়। আমি চাই অ-প্রেমিক হতে, যাতে প্রত্যাখ্যাত না হই। এসব আমার কল্পনা।

বলছিলাম ঝুমবৃষ্টির কথা। আষাঢ়ের বন্দনা। ঝুমবৃষ্টি আমার কাছে সর্বদাই মহামহিম। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ উপঢৌকন। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন মনে করতেন: বৃষ্টি-কুয়াশা সৃষ্টিকর্তার বিশেষ জল। বৃষ্টিতে শুধু প্রেম-ভালোবাসা, অভিসার না, সবকিছুই সুন্দর। নদীর দৃশ্য, উঠোনে পানি, পানির স্রোত, কলা গাছের ভেলায় ভেসে যাওয়া সবই সুন্দর। বৃষ্টিস্নাত সকালের মধ্য দিয়ে শুরু হলো আষাঢ়। আষাঢ় আমাদের আবেগ-অনুভূতি পরিশুদ্ধ করে। ঝুমবৃষ্টি-আষাঢ় ও বাদল দিনে মুগ্ধ হয় নাই কে? কবি, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, রিক্সাচালক, ভ্যানওয়ালা, ঝুপড়িদোকানি, পথচারী সবাই। ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’ বলে প্রণয় নিবেদন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নজরুলের কাছে তো বর্ষা ‘বাদলের পরী’। তিনি লিখেছিলেন: যাও মেঘদূত, দিও প্রিয়ার হাতে আমার বিরহ–লিপি লেখা কেয়া পাতে।’

এই মেঘ এই বর্ষা দেখে নিশ্চিত সবচেয়ে বেশি বিমোহিত হয়েছিলেন কালিদাস। তাই-তো তিনি লিখতে পেরেছিলেন বর্ষাকাব্য, বিরহকাব্য—‘মেঘদূত।’ জীবনানন্দ লিখেছিলেন: এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কতদিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ-বুলায়ে দিয়েছে চুল-চোখের উপরে তার শান্ত-স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে-আবেগের ভরে/ঠোঁটে এসে চুমা দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে।’ হুমায়ুন আহমেদ-তো এক কথা বলে কত মানুষকে কাঁদিয়েছিলেন: ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়।’ আর আমি, সীমান্তের অখ্যাত-ব্যর্থ কবির কাছে আষাঢ়-বর্ষা-বাদল সৃষ্টিকর্তার বিশেষ উপহার। কাল সারারাত আমি শুনছিলাম- ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে/এসো করো স্নান নবধারাজলে।’ এ গান শুনে মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ যেমন আমাদের আধুনিক, অতীত ও ভবিষ্যতের কবি একইসঙ্গে আদি কবিও। এত মুগ্ধতা, এত বিমোহিত আমি আর কোনো গানে পাইনি। তাই বৃষ্টির সাথে এ আদি কবির বন্দনা করি।

প্রকৃতিকে আকুল করে তুলতেই ধরনীতে নামে আষাঢ়, বাদল ও ঝুমবৃষ্টি। ফুটতে শুরু করে বেলি, দোলনচাঁপা, কামিনী, কাঠগোলাপ, মালতি, জুঁই, যূথিকা, বকুল, গন্ধরাজ, শ্বেতচাঁপা, শ্বেতরঙ্গন, লিলি, রজনীগন্ধা, শাপলা, কুন্দ, শ্বেতকাঞ্চনসহ বর্ষার শ্বেতবসনসমূহ। সব তোমার জন্য, তোমাকে মুগ্ধ করার জন্য। বর্ষার দিনে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কদমফুল।

আমি আশায় থাকি এমনই ঝুমবৃষ্টি ও বাদলা দিনের জন্য। আমার ইচ্ছে ছিল—এমনি দিনে টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী কিংবা রোকেয়া হল প্রাঙ্গণে পৃথিবীর সব মিডিয়ার সামনে প্রপোজ করে বলে দিব চিরদিনের সেই কথা। হাত ধরে কৃষ্ণচূড়া সড়কটিতে হাঁটব। গাইব—এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে/আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি/লহো লহো করুণ করে।’